বৃষ্টির দিনের গল্প

ভালোবাসা / ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারী ২০১৫)

মিছবাহ উদ্দিন রাজন
  • ১০
সিএনজি থেকে নেমে প্রায় আধ ভেজা হয়ে এসে কাস্টমর সার্ভিস সেন্টারে ঢুকলো জয়। বাইরে তখন মেঘের বিগড়ে যাওয়া মেজাজের প্রবল দাপট। রাস্তা থেকে তাই এটুকু পর্যন্ত প্রায় তড়িঘড়ি করে এসেও রক্ষা পেল না সে। গায়ের সাথে লেপটে যাওয়া ভেজা টি-শার্টটা টেনে ঠিক করতে করতে ওয়েটিং চেয়ারের সারি আর টোকেন-কাউন্টারকে পাশ কাটিয়ে কখন যে সার্ভিস কাউন্টারের সামনে চলে আসলো, সে টেরই পেলো না। একই সারিতে তিনটা সার্ভিস কাউন্টার। মাথার উপরে ডিজিটাল ডিসপ্লেতে ভেসে উঠা আলাদা আলাদা এক দুই তিন নম্বর দেখে বোঝা যায় এখানে আসলে তিনটা কাউন্টার। তা না হলে, সস্তা ফাস্টফুডের দোকানে দেয়াল ঘেঁষে পাকা করা উঁচু টেবিলগুলোর মতো লম্বা একটা ডেস্কেই তিনটা কাউন্টারকে আলাদা ভাবা বাইরের লোকের পক্ষে বেশ কঠিন হতো।

জয় সোজা হেঁটে এসে দুই নম্বর কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছে। কাচের পাল্লার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সোজা হেঁটে সার্ভিস কাউন্টার পর্যন্ত আসলে দুই নম্বর কাউন্টারই সামনে পড়ে। দুই নম্বর কাউন্টারে ডেস্কের দিকে একেবারে ঝুঁকে পড়ে কাজ করতে থাকা মেয়েটাকে দেখে তৎক্ষণাৎ চমকে উঠলো জয়। মিথিলা ! চমকে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই সচেতন হয়ে উঠলো সে। ভেজা শরীরের রিনরিনে অনুভূতিটুকু এক ধাক্কায় উবে গেল। এক এবং তিন নম্বর কাউন্টারের অবস্থান দুই নম্বর কাউন্টারের দুইপাশে। মিথিলা কে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত দুই পাশের কাউন্টার দুইটার দিকে চোখ ঘোরালো জয়। দুইটা কাউন্টারই খালি এবং উপরে কাউন্টারের নম্বর ভাসা ডিজিটাল ডিসপ্লেতেই লাল রঙের ইংরেজি অক্ষরে লেখা 'ক্লোজড' শব্দটা নির্দিষ্ট সময় পরেপরে উঠা নামা করছে। অর্থাৎ, দুই নম্বর সার্ভিস কাউন্টারেই আপাতত কাজ সারতে হবে! অসম্ভব! আসন্ন অপ্রস্তুত অবস্থাটা তৎক্ষণাৎ চিন্তা করতে পেরে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই জয় শুনল, " কী ভাবে আপনাকে হেল্প করতে পারি, স্যার? "

দ্বিধান্বিত মুখটা কাউন্টারের দিকে ঘুরিয়ে এক নিঃশ্বাসে সে বললো, " আমার একটা মোবাইল হারিয়ে গেছে। সিমটা আবার তুলতে চাচ্ছি।"
" এ জন্য স্যার, টোকেন কাউন্টার থেকে সিম রি-প্লেসমেন্টের জন্য একটা টোকেন নিতে হবে, এবং টোকেনে যে সিরিয়াল আসবে সে সিরিয়াল পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। "
ডেস্কের উপর ছড়ানো জরিপের ফর্মের মতো কতগুলো কাগজে চোখ বুলানোতে ব্যস্ত থেকেই এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো মিথিলা । একবারের জন্য ও জয়ের দিকে সে চোখ তুলে তাকালো না।
আশ্চর্য! কাস্টমর সার্ভিসে কাজ করতে থাকা একজন মানুষ কীভাবে সার্ভিস গ্রহণের জন্য আসা একজন কাস্টমের সঙ্গে এর কম অসম্পূর্ণ মনোযোগ থেকে কথা বলে? পেশাগত মূল্যবোধ বলতে কি কোন বিষয় এদের মধ্যে নেই? না কি জয়ের জন্য ই শুধু এই ব্যতিক্রম?

হয়তো ভেজা টি-শার্ট ঠিক করতে করতে বে-খেয়ালে হেঁটে আসার সময় ই মিথিলা দেখে ফেলে ছিল তাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেও সচেতন হয়ে গিয়ে ছিল। এজন্য ই একবারের জন্য ও সে ডেস্ক খেকে চোখ তুলেনি। আর অন্তত ন্যূনতম পেশাগত মূল্যবোধের কারণেই যোগাযোগের অসম্পূর্ণতা রেখে হলেও সে জয়ের সাথে কথা বলেছে এবং প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু জানিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় চিন্তাটাই ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ধরে নিয়ে তৎক্ষণাৎ পা দুইটাতে দ্রুততা আনলো জয়। দ্রুত পায়ে দরজা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে কাচের পাল্লা ঠেলে বাইরের দিকে গলা বাড়াল সে। হেমন্তের বেপরোয়া বৃষ্টির আঘাত বুক পেতে সহ্য করছে নিথর শহুরে রাস্তা। রাস্তার এপাশে একটাও রিকশা-সিএনজি নেই। ঠিকও পাশে আট-দশজন লোক গুটিয়ে ফেলা একটা ফলের দোকানের উপর টানানো একটা ত্রিপলের নিচে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করছে কোনো রকমে।
ওভার ব্রিজ পর্যন্ত হেঁটে যেতে গেলে ভিজে এক শেষ হওয়া ছাড়া আর কোন পথ দেখলো না জয়। এটুকু জায়গা ভিজে যাওয়ার মতো ইচ্ছাও আসলো না ভেতর থেকে। কে জানে, অবচেতনে উঁকি দিতে থাকা ক্রমাগত মানুষকে জানার নেশাটুকুই হয়তো নিয়ন্ত্রণ করে ফেললো তাকে।
ফিরে এসে টোকেন কাউন্টার থেকে সিম রি-প্লেসমেন্টের জন্য একটা টোকেন নিলো সে। টোকেনে সিরিয়াল নম্বর আসলো ১৫১। ওয়েটিং চেয়ারে বসার আগে কাউন্টারের ডিসপ্লে'র দিকে তাকিয়ে দেখলো সে। ১৩৪ নম্বর সিরিয়াল চলছে। বসতে হবে আরো অনেকক্ষণ। ওয়েটিং চেয়ারের বিপরীত দিকের দেয়াল ঘেঁষা ফ্ল্যাট টিভিতে ঘুরেফিরে তিন-চারটা কর্পোরেট বিজ্ঞাপনই দেখানো হচ্ছে। এর মাঝে একটা বিজ্ঞাপন আবার জয়ের নিজের বানানো। নব্বই সেকেন্ডের একটা বিজ্ঞাপনচিত্র। গ্রামের সহজ-সরল জীবন ধারায় ও কী ভাবে এই নির্দিষ্ট কোম্পানির টেলিকম সার্ভিস অপরিহার্য হয়ে উঠেছে তার ইমোটিভেশনাল দৃশ্যকল্প। একটু পরপরই নিজের বানানো বিজ্ঞাপনচিত্রটা দেখে অস্বস্তিতে দুমড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো তার।

একে তো বৃষ্টির দিন, তাও আবার সার্ভিস সেন্টারের পুরোটাই এয়ারকন্ডিশন্ড। এর মাঝেও পুরো শরীরে ঘেমে উঠার একটা অনুভূতি বোধ করলো জয়। সৃজনশীল মানুষদের এই একটা সমস্যা - নিজের কষ্টের সৃষ্টিগুলোকে এক সময় সস্তা এবং অসম্পূর্ণ মনে হয়। নিজের চোখের সামনে বারবার চলতে থাকা নিজের বানানো বিজ্ঞাপন চিত্রটাকে স্রেফ লোক ঠকানো একটা কাজ বলে মনে হতে থাকলো জয়ের কাছে।
জয়ের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, এ রকম হয়। পড়াশোনা শেষ করা টগবগে তরুণদের একদল প্রথম দিকে ব্যাপক মাত্রায় সমাজ সচেতন থাকে । বেকার অবস্থায় সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা, রাতের পর রাত শোষণমূলক কর্পোরেট পলিসির সমালোচনা আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে তর্ক করতে করতে মুখে ফেনা তুলে। দিনে দিনে সিগারেটের ব্র্যান্ড বেনসন থেকে ডারবিতে নামে। চায়ের টঙে বাকির খাতা ভারী হতে থাকে । ক্রমান্বয়ে এদেরই অনেকে এক সময় সরকারি চাকরির জন্য মরিয়া হয়ে উঠে, আর একটা কর্পোরেট কাজ তো এক সাথে 'রথও দেখলাম, কলাও বেচলাম' এর মতো। বাস্তবতার এই রূঢ়তা মেনে নেওয়া ছাড়া আর করার থাকে কি?

আত্ম সমর্থনমূলক চিন্তা টুকু করে শেষ করার আগেই দুই নম্বর কাউন্টার থেকে মিষ্টি নারী কন্ঠ ভেসে আসে, "সিরিয়াল নাম্বার একশো একান্ন..."
দুই নম্বর কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো জয়। হারানো সিমের নম্বরটা জানতে চেয়ে ল্যাপটপে তথ্যগুলো চেক করে দেখতে দেখতে দেখতে মৃদু হেসে মিথিলা বলে, " খুব এমবিশাস একজন চোর মনে হচ্ছে! এত বড় একজন সেলেব্রিটির মোবাইল চুরি করা অনেক বড় এমবিশানের ব্যাপার! "
"মোবাইলটা চুরি হয়নি। হারিয়ে গেছে। আর আমি মোটেও সেলিব্রিটি না। 'সেলেব্রিটি' শব্দটাতে আমার মাথাধরে। " মানিব্যাগ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র আর ছবিটা বের করে দিয়ে বলে জয়।
" ওহ, সরি! শব্দটা 'লিজেন্ড' হবে। এই ফর্মটা পূরণ করতে হবে।"
ফর্মটা জয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে মিথিলা ।
শেষ কথাগুলো উত্সাহ মূলক নাকি বিদ্রূপাত্মক মিথিলা র মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারলো না জয়। গলার স্বর শুনে আবার দুইটাকেই সম্ভাবনাময় বলে মনে হলো তার কাছে।

মেয়েদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের দুর্বলতা বুঝে নিয়ে সব সময় উল্টো কাজগুলো করে নিজেদের প্রতি তাদেরকে আকৃষ্ট করে রাখার জন্য । মিথিলা যে এখনও এদেরই অন্তর্ভুক্ত এই তিন বছরে প্রতি নিয়ত নিজের ভেতরে চলমান আকাশ-পাতাল পরিবর্তনের কারণে এতক্ষণ বুঝতেই চায়নি জয়। ব্যাপারটা বুঝে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই ভেজা শরীরে সার্ভিস সেন্টারে ঢোকার পরের পরিস্থিতি টুকুর ব্যাখ্যা পেয়ে গেলো সে।

ফর্মটা পূরণ করে সিম রি-প্লেসমেন্টের জন্য নির্ধারিত টাকাটা দিলো জয়। এরই মাঝে জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি রেখে মূল পরিচয়পত্রটা জয়ের কাছে ফিরিয়ে দিলো মিথিলা। সাথে ফর্মটার একটা কার্বন কপি, মানিরিসিপ্ট আর নতুন সিম।
" আর বলবেন না, টানা আট ঘণ্টা বসে থাকতে থাকতে দমবন্ধ হয়ে আসে। আপনারা কতো জায়গায় ঘুরেন, কতো মানুষের সাথে মেশেন। মজার লাইফ!" এটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মিথিলা ।
" আজকের শিফট কয়টা পর্যন্ত? '' মোটামুটি বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি হিসাবে একটা কিছু কথাজুড়ে জয়।
" পাঁচটা পর্যন্ত। আ...রো...ওদ...শমিনিট! শেষের দিকের সময় টুকু এত বিরক্তি কর লাগে! উফফ! "
দীর্ঘ বিরতির পরে ঘনিষ্ঠজনদের সাথে দেখা হলে মানুষ বিভিন্ন ভাবে একজন আরেক জনের পরিবর্তনটুকু জানতে চেষ্টা করে। এটা সহজাত। নিজের মানসিক অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে জয় বলে,
" আচ্ছা, বৃষ্টি থেমেছে। আমি ওভারব্রিজের কাছে অপেক্ষা করছি। " " না, না। অপেক্ষা করতে হবে না। লোকজন ডিস্টার্ব করবে তো আপনাকে! "
" এখানে কেউ ডিস্টার্ব করেনি। ওখানেও করবে না। আমাকে কেউ চেনে না। " নিজেকে নিজেই কটাক্ষ করার সুরে কথাগুলো বলে বেরিয়ে আসে জয়।

বৃষ্টি শেষে ওভারব্রিজের কাছের ফুটপাতের দোকানগুলো আবার বসতে শুরু করেছে। কয়েকটা ফলের দোকান। কতগুলো কাপড়ের দোকান। ভাজা ছোলা-বাদামের ভ্যান। জুতাসেলাইয়ের মুচি। একটা ভাসমান চা-সিগারেটের দোকান। কাছেই রাস্তার ঢালে আধ ডোবা হয়ে কাত হয়ে পড়ে থাকা একটা রিকশা। ফুটপাত ঘেঁষা ময়লা পানির স্রোত। পুরো ঢাকা শহরের মিলিত প্রশান্ত দীর্ঘশ্বাস। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সব কিছু কে আবার নতুন করে দেখার চেষ্টা করে জয়। হঠাত্ করে একটা ছন্দ পতন ঘটার পরে কী করে আবার সব কিছু শুরু হয়। স্বাভাবিক ভাবে আগের উদ্যম নিয়ে সব কিছু শুরু করা যাচ্ছে কি? না, যাচ্ছে না। অনিচ্ছাকৃত বিরতিটার পর নতুন ভাবে সব কিছু শুরু করতে গিয়ে সবগুলো কাজেই কেমন যেন একটা গুমোট ধরা ক্লান্তি আর দায়সারা ভাব। কাজগুলো করে বাঁচতে হবে তাই সবাই করছে। কাজগুলোর পেছনে ক্লান্তিকর দায়বদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না জয়।

দূর থেকে হালকা বেগুনি রঙের টপটা দেখে মিথিলা কে চেনা যায়। রোগা পা দুইটার শৈল্পিক পদক্ষেপে এগিয়ে আসে সে। আকাশ এখনো মেঘলা থাকায় তার গায়ে জড়ানো বেগুনি রঙটার আলাদা কোন তাৎপর্য ফুটে উঠে না। সকাল বেলা রোদ ছিল, তখন হয় তো রঙটার আলাদা দ্যোতনাও ছিলো। এখন রোদ নেই, রঙটা ফিকে হয়ে এসেছে। মিথিলার চোখে-মুখেও ক্লান্তির ছাপ।
" চা খাবেন? " ভালোমতো কাছ পর্যন্ত আসার আগেই কেমন যেন অপ্রস্তুতের মতো বলে উঠে মিথিলা ।
নিজের পরিচিত পরিবেশে অনেক কঠিন পরিস্থিতিকেও সহজে সামলে চলা যায়। এতক্ষণ নিজের কাজের ভেতরে থাকার কারণেই হয়তো জয়ের সামনে মিথিলার এই অপ্রস্তুত ভাবটা বেরিয়ে আসেনি। এখন এসেছে।
" হ্যাঁ, খাবো। চলো, ওই দিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাই। " শান্ত গলায় বললো জয়।
রাস্তার পাশের ভাসমান চায়ের দোকানটা থেকে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খায় দুইজনে। রাস্তায় যান বাহনগুলোর ক্যা কা ফোনি বাড়ে, আশেপাশে মানুষের ভিড় আর হট্টগোল। নিচের দিকে ফাটল ধরা কাচের কাপটাতে কয়েকটা নিঃশব্দ চুমুক দেওয়ার পর স্থিরগলায় জয় বলে, "আমি জানতাম না, তুমি এখানে কাজ করো। ''
নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে গেলে গুণাগুণে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলো মিথিলা । নিচের দিকে তাকিয়েই সে বলে,
" জানলে? "
সিমের কাগজ পত্র ভরতি খামটা যে হাতে ছিলো সে হাতটা দিয়ে কোমরে ধরে দাঁড়িয়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা করে জয়,

"আসলে আমার সিমটা তোলা জরুরী ছিলো। আর এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, তাই ..."
"আমি আছি জানলে আপনি কখনোই আসতেন না, এইতো? "
ভ্রু দুইটার মাঝ খানের দূরত্ব কম এবং ভ্রু সন্ধির ঠিক মাঝ খানে ছোট্ট বেগুনি টিপ। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকায় জয়ের কাছে কাপের বেষ্টনীর বাইরের মিথিলার মুখমণ্ডলের এই অংশকে পৃথিবীর সব চেয়ে স্নিগ্ধ ও সমৃদ্ধ শিল্পকর্ম বলে মনে হয়। কথার খেই হারিয়ে ফেলে জয়,
"বিয়ে করছো কবে? ''
"ওমা! আপনি জানেন না, আমার বিয়ে হয়ে গেছে? " পরম সত্য বলার মতো করে চোখে-চোখে তাকিয়ে বলে মিথিলা । নিজস্ব উল্টো আচরণ রীতিতে আবার ফিরে গেছে সে। জয় বুঝতে পেরে মনে মনে হেসে উঠে।
কিন্তু চোখে মুখে প্রকাশ না করে বলে, " তুমি যে এখনো বিয়ে করোনি, সেটা তো ভালো ভাবেই বোঝা যাচ্ছে!"

চোখ দুইটা ছোট করে অবিশ্বাস প্রকাশ করে মিথিলা ,

"একটু পরেই ও আসছে। আমি ওর সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। ''
আর হাসি চেপে রাখতে পারে না জয়। হু হু করে হাসতে হাসতে চায়ের বিলটা আর কাপটা ফেরত দিয়ে বলে,
"চলো, সামনে আগাই। ''
"আপনি আমাকে নিয়ে মজা করছেন এখন? "
"না! অবশ্যই না! তোমাকে নিয়ে মজা করবো কেন? চলো, সামনে আগাই। জায়গাটা খালি করে দেই। "
কোনো মতে বাইরের হাসি থামায় জয়। ভেতরে ভেতরে সঙ্গীতের রেশের মতো হাসির রেশ তরঙ্গায়িত হতেই থাকে । ইন্টারনেটে সাবেক প্রেমিক-প্রেমিকার খোঁজ-খবর সবাই রাখতে চায়। সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও বিয়ে সম্পর্কিত খবরাখবর এমনিতেই পাওয়া যায়। আর মেয়েরা তো সোশ্যালনেটওয়ার্কিং সাইটে স্বামীর সঙ্গে অন্তত একটা যুগল ছবি হলেও আপলোড করবে। সে স্বামী সিনেমার হিরো বা রাম ছাগল, সমাজকর্মী বা চাউলের আড়তদার যে-ই হোক। আর এর কম উল্টো আচরণের মেয়েরা একাজটা আরো বেশি করে দুইটা উদ্দেশ্যে – স্বামীকে দেখানোর জন্য, দেখো, তোমাকে নিয়ে আমি কত্ত সুখী! আর সাবেক প্রেমিক বা প্রেমিকদেরকে দেখানোর জন্য, দেখো, তোমাকে ছাড়া আমি কত্ত সুখী! প্রকৃত পক্ষে সে একদমই সুখী হোক বা না হোক।

মুখ ভরে আবার হাসি বেরিয়ে আসার মুহূর্তেই ঘুরে গিয়ে ওভারব্রিজের মোড় থেকে ফুটপাতে উঠে যায় জয়। পেছনে পেছনে আসে মিথিলা ।
"কী করে আপনি এত কনফিডেন্টলি বললেন, আমি এখনো বিয়ে করিনি? আমাদের বিয়ের প্রায় চার মাস হতে চললো! ''
"আরে, এটা তো খুবই সিম্পল হিসাব। একজন ম্যারেড উইমেন তার এক্স-বয়ফ্রেন্ডের সাথে তার হাজব্যান্ডকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক সাথে চা খাবে আর এতক্ষণ ধরে গল্প করবে – এটা কোন লজিক হলো!''
মিথিলা চুপসে যায়। সত্যি হলে ব্যাপারটা বেশ জটিল এবং ফালতু একটা ব্যাপার হতো। বাচ্চাদের মতো দুই দাঁতের পাটি এক করে হেসে সে বোঝাতে চায়, আসলে সে ইচ্ছা করেই জয়ের সঙ্গে এতক্ষণ মজা করেছে। এরপর সাথে সাথে সে প্রসঙ্গ পালটে ফেলে,
" তো, আপনার সিনেমা কবে দেখার সৌভাগ্য হবে? ''
"অতই যদি সহজ হতো, তাহলে তো রহিম-করিম সবাই অন্তত নিজের লাইফ নিয়ে একটা করে সিনেমা বানিয়ে ফেলতো! "

বিয়ের প্রসঙ্গে ভান করে ধরা খাওয়ার পর থেকে মিথিলা র মধ্যে হঠাত্ করেই একরমের তাড়া চলে এসেছে। ঘন ঘন রাস্তায় বাসের দিকে তাকাচ্ছে এবং এরই মাঝে একবার ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করে সময়ও দেখে নিয়েছে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক গলায় হঠাত্ অরেকটা বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন করে সে,
"সিগারেট খান না? "
"হ্যাঁ, খাই তো! '' জয় সহজ জবাব দেয়।
"দেখে অবশ্য তা মনে হয় না। '' পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে আপাদমস্তক জয়ের উপর চোখ বুলিয়ে গলার স্বর টেনে টেনে বলে মিথিলা ।

"মানে! কীমনেহয়? '' রোজরোজ এতগুলো সিগারেট খায় সে। চেহারায় কি এতটুকুও ছাপ পড়েনি? খুবই অবাক হয় জয়।
"মনে হয়, খালি সিগারেটই না। আরো অন্য কিছু ওখান... এই ধরেন, গাঁজা-টাঁজা! ''
হাসতে হাসতে এবার একেবারেই লুটিয়ে পড়ার অবস্থা হয় জয়ের,
"না, ওরকমের অন্য কিছু খাই না আমি। ''
"আমাকে বাসে উঠতে হবে! '' হাসির রেশটা আর বেশি ক্ষণ রাখতে দেয় না মিথিলা । ওভারব্রিজের মোড়ে এসে থামা মিরপুরের দিকের একটা বাসের উদ্দেশ্যে প্রায় ছুটে আগায় সে,
"চলে যাচ্ছি, ভালো থাকবেন।"
"হ্যাঁ, অবশ্যই! ''
জয়ের কথাটা শেষ হতে না হতে ই দ্রুত ভিড় ঠেলে বাসের ভেতর হারিয়ে যায় মিথিলা । মিথিলা চলে যাচ্ছে, ব্যাপারটা জয় ভালো করে বুঝে উঠার আগেই পেছনে লাইন ধরা এক সারি বাস আর লেগুনার আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকে বাসটা।
দূর রাস্তার দিকে তাকিয়ে বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়। তিন বছর নিতান্তই কম সময় নয়। এই দীর্ঘ সময়েও আপাত তেমন পরিবর্তনই আসেনি মেয়েটার মধ্যে। আগের সময় গুলোর কথা মনে করতে গিয়ে বুকের ভেতর পাখির ডানা ঝাপটানো টের পায় জয়। ভালো মতো চেষ্টা করলে হয় তো রিলেশনটাকে ঠিকঠাক করা যাবে আবার। কিন্তু অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির শেষে আবার নতুন করে শুরু করতে যাওয়া কাজগুলোর মতোই যদি ক্লান্তিকর আর দায় সারা হয়ে উঠে সবকিছু ? না, এই ক্লান্তি আর দায়সারা ভাবটাকেও দূরকরা যাবে। পরক্ষণেই আবার মনে হয়, না, এত সময় কোথায় হাতে? শহুরে যান্ত্রিক বাস্তবতা ভালোবাসার জন্য জমারা খাটু করো টুকরো সময় গুলোকে লিটমাস পেপারের মতো চুষে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাছাড়া, দীর্ঘ সময়ের বিরতি, দীর্ঘ সময়ের নতুন নতুন অভ্যাস!

আচ্ছা, আমি তোমাকে খুব মিস করি! 'মিস' কথাটার সাথে অভ্যস্ত হওয়ার আগে কী বলতো মানুষ? ''তোমার কথা খুব মনে পড়ে", "তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করে", "তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে " - নাহ! কোন কিছু তেই 'মিস' শব্দটার সমান গভীরতা খুঁজে পায় না জয়। দীর্ঘ দিনের অনভ্যাসে পুরনো অনেক আবেগের গভীরতা কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
একেবারে মাথা উলটে আকাশের দিকে তাকায় জয়। ধীরে ধীরে আবারও ভারী হচ্ছে আকাশটা। আবারও বৃষ্টি নামবে। কারো কারো আবশ্যিক কাজগুলোতে আবারও অপ্রত্যাশিত বিরতি। একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা দুইটাতে ব্যথা ধরে গেছে। দ্বিতীয়বার বৃষ্টি নামার আগেই কোথাও একটু বসা দরকার।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিছবাহ উদ্দিন রাজন পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ । আমার পাঠানো dox file টা ভেঙ্গে গিয়েছিলো । পরে এডিট করতে গিয়ে লেখাটার এই অবস্থা হয়েছে ।
পবিত্র বিশ্বাস অনেক ভাল লাগলো... শুভ কামনা সাথে আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ রইল। ভোটও করলাম।
ভালো লাগেনি ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
সবুজ আহমেদ কক্স darun @@@ misbaha uddin rajan
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
Salma Siddika অনেক ভালো লাগলো, মনে হলো বৃষ্টি শেষের দৃশ্য গুলা আমি আগে দেখেছি. ভোট করলাম
ভালো লাগেনি ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
রবিউল ই রুবেন ভালো। আশা করছি ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু পাবো। শুভকামনা সাথে ভোট। আমার গল্প ও কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
ফাহিম তানভীর ভাল হয়েছে । ভোট রইল।আমার গল্পটিও পড়ে দেখবেন আশা করি :)
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
এশরার লতিফ খুব পরিপক্ক গল্প, বরাবরের মত। অনেক ভালো লাগলো।
ভালো লাগেনি ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
মোঃ আক্তারুজ্জামান চেষ্টা করুন, লেখাটা সংশোধিত হলে আবার আসব।
ভালো লাগেনি ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
Salma Siddika গল্প তো পড়তে পারছি না.....আপনার লেখাটা এডিট করতে হবে.
ভালো লাগেনি ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

০৬ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী